Continuous Improvement

ক্রমাগত উন্নতি (Continuous Improvement ) হলো একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। মানে আপনার প্রতিনিয়ত ছোট ছোট পরিবর্তনের মাধ্যমে কাজের মান, গতি, খরচ এবং দক্ষতা উন্নত করন কে বুঝায়। এটি কেবল একটি টুল বা কৌশল নয়, বরং একটি মাইন্ডসেট যা “আজকের চেয়ে আগামীকাল আরও ভালো” হওয়ার চেষ্টাকে উৎসাহিত করে। তৈরি পোশাক শিল্পে ক্রমাগত উন্নতির গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এই শিল্পে প্রতিযোগিতা তীব্র, লিড টাইম কম, ও ক্রেতার মান-চাহিদা বেশি। উৎপাদনে সামান্য অপচয় বা বিলম্বও পুরো অর্ডার ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ক্রমাগত উন্নতির মাধ্যমে কারখানাগুলো উৎপাদনের গতি বাড়াতে, ত্রুটি কমাতে, খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং গ্রাহকের সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়। এটি শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং প্রক্রিয়াগত স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেও শিল্পটিকে আরও টেকসই করে তোলে।
Continuous Improvement এর কারণ।

আমরা প্রায়শই শুনি,একটি প্রতিষ্ঠানকে টিকে থাকতে হলে দরকার খরচ নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কার্যকর মাননিয়ন্ত্রণ, গ্রাহক সন্তুষ্টি, অপারেশন এক্সিলেন্স এবং সর্বোপরি ক্রমাগত উন্নয়ন। এই শব্দগুলো শুধু কর্পোরেট স্লোগান নয়, বরং একটি প্রতিষ্ঠানের সফলতার ভিত্তি। কিন্তু অনেকেই জানি না—এই শব্দগুলো বাস্তব জীবনে কীভাবে প্রয়োগ করব, কিংবা কোন দিক থেকে শুরু করব। তা বিস্তারিত জানবো আজকের ব্লগে।
আপনি যদি লক্ষ্য করেন, এ সব শব্দ একই সুতোয় গাঁথা—একটি শক্ত ভিত, যার নাম Continuous Improvement। এটাই সেই সূচনা বিন্দু, যেখান থেকে প্রতিষ্ঠান নিজেকে রূপান্তরিত করতে পারে। “যে প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন নিজেকে একটু করে ভালো করে, সে প্রতিষ্ঠানই ভবিষ্যতে সবচেয়ে বড় হয়।” এই মাইন্ডসেট থেকেই শুরু করুন। প্রথমেই ফোকাস করুন প্রক্রিয়াগত উন্নয়নে। ফলাফলস্বরূপ অপারেশন দক্ষতা বাড়বে, উৎপাদনশীলতা উন্নত হবে, গুণগত মান নিশ্চিত হবে এবং শেষ পর্যন্ত—গ্রাহকের সন্তুষ্টিই হয়ে উঠবে প্রতিষ্ঠানের শক্তিশালী মূলধন।
ক্রমাগত উন্নতির ধারণা :
Continuous Improvement বা ক্রমাগত উন্নতির ধারণা মূলত জাপানি দর্শন “Kaizen” থেকে এসেছে, যার অর্থ “নিরবিচারে ভালো করা” বা “ভালোর জন্য পরিবর্তন।” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের শিল্প পুনর্গঠনের সময় এই পদ্ধতির বিকাশ ঘটে। বিশেষত Toyota Production System-এ Kaizen প্রয়োগ করে উৎপাদনের গুণমান ও দক্ষতায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা হয়। এই ধারণার উৎপত্তি হয়েছিল এমন একটি সময়ে, যখন শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়ম, অপচয় ও মানহীনতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। ফলে প্রয়োজন দেখা দেয় এমন একটি পদ্ধতির, যা ধাপে ধাপে উন্নয়ন সাধন করবে—ছোট ছোট পরিবর্তনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে বড় ফলাফল আনবে।
Continuous Improvement তাই শুধু সমস্যা সমাধানের কৌশল নয়, বরং একটি মানসিকতা, যা কর্মীদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ, সমস্যার মূল কারণ খোঁজা, এবং প্রতিনিয়ত উন্নয়ন সাধনে অনুপ্রাণিত করে। এজন্য এটি আজ বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর একটি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি।
ক্রমাগত উন্নতির এর বড় উদহারণ হলো Kaizen মতবাদ:
Kaizen একটি জাপানি শব্দ, যার অর্থ “ভালোর জন্য পরিবর্তন” বা “নিরবিচারে উন্নয়ন”। এটি একটি ব্যবস্থাপনা দর্শন, যা ধাপে ধাপে, ধারাবাহিকভাবে উন্নয়ন ঘটানোর ওপর গুরুত্ব দেয়। Kaizen-এর মূল বিশ্বাস হলো—ছোট ছোট ইতিবাচক পরিবর্তনসমূহ একত্রে বড় রূপান্তর ঘটাতে পারে। Kaizen মূলত কর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, দলগত সমস্যা সমাধান এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপ বিশ্লেষণ করে উন্নয়নের পথ খুঁজে বের করার উপর ভিত্তি করে। এটি PDCA চক্র (Plan-Do-Check-Act) অনুসরণ করে:
সমস্যা চিহ্নিত করার পরিকল্পনা
সমস্যা সমাধান প্রয়োগ করা।
সমাধানের ফলাফল মূল্যায়ন করা।
সফল হলে সেই প্রক্রিয়াটি কন্টিনিও করা।
Kaizen সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি স্তরে, বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের ক্ষমতায়ন করে, উৎপাদনের মান, গতি ও খরচে উন্নয়ন ঘটায়। এটি টেকসই উন্নয়নের অন্যতম কার্যকর উপায়।
ক্রমাগত উন্নতির মূলনীতি:
Continuous Improvement বা ক্রমাগত উন্নতির মূলনীতিগুলো এমন কিছু ভিত্তির উপর গঠিত যা প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী উন্নয়ন এবং উৎপাদনে উৎকর্ষতা আনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ছোট ছোট পরিবর্তন: সব সময় নিশ্চিত করুন আপনি প্রতিদিন ছোট পরিসরে ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করছেন কারন এর মাধ্যমে আপনি দীর্ঘমেয়াদি ফল নিশ্চিত করতে পারবেন।
কর্মীদের সম্পৃক্ততা:যারা প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছেন তারাই সবচেয়ে ভালো জানে কোথায় সমস্যা—তাদের মতামত গ্রহন করুন এবং ক্রমান্বয়ে উন্নতির পথে চালিত করুন।
গ্রাহককেন্দ্রিকতা: মনে রাখবেন সব উন্নতির লক্ষ্য হলো গ্রাহকের সন্তুষ্টি অর্জন।
প্রক্রিয়াভিত্তিক চিন্তাধারা: শুধু ফলাফল নয়, প্রতিটি ধাপে উন্নয়ন ঘটানোই যেন আপনার মুল উদ্দেশ্য হয়।
ডেটাভিত্তিক সিদ্ধান্ত: কোন অনুমান নয় আপনি পরিসংখ্যান পবেক্ষন করুন, পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিনি।
অপচয় হ্রাস: কোন বিষয়গুলো অপচয় হচ্ছে তা নিরক্ষন করুন ও শ্রমের অপচয় কমিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি করুন।
এই মূলনীতিগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান ক্রমাগত উন্নতির সংস্কৃতি গড়ে তোলে।
লীণ সিক্স সিগমায় Continuous Improvement প্রসেস:
ক্রমাগত উন্নতি বাস্তবায়নের জন্য Lean ও Six Sigma দুইটি কার্যকর প্রক্রিয়া, যা একসাথে প্রয়োগ করলে উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা যায়।
আমরা জানি Lean মূলত অপচয় (waste) হ্রাস করা। এর মাধ্যমে সেই প্রক্রিয়া খুঁজে বের করে, যেগুলো গ্রাহকের জন্য মূল্য তৈরি করে না এবং সেগুলো বাদ দিলেও সমস্যা হয়না। Lean-এর ৭টি অপচয় হলো: সময় অপচয়, অতিরিক্ত উৎপাদন, অপেক্ষা, অতিরিক্ত মুভমেন্ট, ত্রুটি, অতিরিক্ত প্রসেস এবং অতিরিক্ত স্টক।
পক্ষান্তরে Six Sigma এর লক্ষ্য হলো প্রক্রিয়ার বৈচিত্র্য ও ত্রুটি কমিয়ে গুণগত মান উন্নয়ন। এটি ডেটা-ভিত্তিক DMAIC (Define, Measure, Analyze, Improve, Control) চক্র অনুসরণ করে সমস্যার মূল কারণ চিহ্নিত করে এবং টেকসই সমাধান দেয়। এই দুটি একত্রে ব্যবহারে প্রতিষ্ঠান একই সঙ্গে খরচ কমাতে, গুণগত মান বাড়াতে ও গ্রাহক সন্তুষ্টি নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়, যা Continuous Improvement-এর মূল উদ্দেশ্য।
ক্রমাগত উন্নয়নের এ লীণ সিক্স সিগমা প্রসেস এর বাস্তব উদহারন।
গত বছর জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তৈরি পোশাক শিল্পের একটি স্যাম্পল ও ইনোভেশন সেন্টারে প্রচুর স্যাম্পল ব্যাকলগ তৈরি হয়। স্যাম্পল সময়মতো সাবমিট না হওয়া, অনুমোদনের হার কমে যাওয়া এবং গ্রাহকের নেতিবাচক মন্তব্য পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে। সমস্যা সমাধানে আমরা Lean Six Sigma পদ্ধতি গ্রহণ করি। প্রথমে Lean প্রয়োগ করে অপচয়ের মূল কারণ যেমন সময়মতো চাহিদাপত্র না আসা, কাঁচামালের অসংগতি, প্যাটার্ন ত্রুটি, অতিরিক্ত মুভমেন্ট ও অপেক্ষা শনাক্ত করি। এরপর Six Sigma‘র DMAIC চক্র অনুসরণ করে সমস্যাগুলোর গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ ও সমাধান করি। সবচেয়ে বড় বাধা ছিল রিওয়ার্ক, রিস্ক ফ্যাক্টর অ্যানালাইসিস ও কাঁচামালের সরবরাহ ঘাটতি, যা সুইং লিড টাইম দীর্ঘ করে দেয়। ধাপে ধাপে উন্নয়নের ফলে রিওয়ার্ক ৫৩% কমে, উৎপাদনের সময় ২০% হ্রাস পায় এবং গ্রাহক সন্তুষ্টি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এটি প্রমাণ করে, Lean Six Sigma একটি কার্যকর উন্নয়ন কৌশল।
ক্রমাগত উন্নতির ৫ টি প্রিন্সিফাল:
যে কোন বিষয় নিয়ে ক্রমাগত উন্নয়ন সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতি বা Principle গ্রহন করতে হয় । কিন্তু হ্রমাগত উন্নয়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হলে আপনাকেও অবশ্যই কিছু নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে । আসুন জেনে নেই রা হয় ক্রমাগত উন্নয়ন এর জন্য কোন কোন নীতিমালা গুলো গ্রহন করা প্রয়োজন।
Customer Focus (গ্রাহক-কেন্দ্রিকতা):উন্নয়নের প্রতিটি পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য হলো গ্রাহকের প্রয়োজন ও সন্তুষ্টি পূরণ করা।
Employee Involvement (কর্মীদের সম্পৃক্ততা): কর্মীরা সমস্যার প্রকৃত উৎস জানেন। তাদের মতামত, অংশগ্রহণ ও উদ্ভাবন প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নেয়।
Process-Centered Approach (প্রক্রিয়াভিত্তিক পদ্ধতি):ফলাফলের পরিবর্তে প্রতিটি প্রক্রিয়ার উন্নয়নে জোর দিলে দীর্ঘমেয়াদে গুণগত পরিবর্তন আসে।
Data-Driven Decision Making (তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত):অনুমান নয়, বরং তথ্য, পরিসংখ্যান ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে উন্নয়নের দিকনির্দেশ ঠিক করতে হয়।
Standardization and Continuous Feedback (মান নির্ধারণ ও প্রতিক্রিয়া):
সফল প্রক্রিয়াগুলো মান হিসেবে নির্ধারণ করা এবং ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে উন্নয়ন অব্যাহত রাখা।
উপসংহার:
আপনি যদি প্রতিদিন একটু একটু পরিবর্তন আনেন, তবে এই ছোট পরিবর্তনই ভবিষ্যতের সফলতার ভিত্তি গড়ে তোলে। যে প্রতিষ্ঠান নিয়মিত উন্নয়নের চর্চা করে, সেই প্রতিষ্ঠানই টিকে থাকে, বড় হয় এবং সম্মান অর্জন করে। ক্রমাগত উন্নতি হলো একটি কৌশলগত মানসিকতা, যা চটজলদি সমাধান নয় বরং শৃঙ্খলিত পরিবর্তনের একটি নিয়মিত রীতি। Lean ও Six Sigma পদ্ধতি অনুসরণ করে ছোট সমস্যা চিহ্নিত করে ধাপে ধাপে কার্যকর পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়। এই পরিবর্তনের ফলে তৈরি হয় অপারেশন এক্সিলেন্স, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং গুণগত মানের উন্নয়নে গ্রাহক সন্তুষ্টি অর্জন হয়।
প্রতিদিন ১% করে ভালো করার নীতি হয়তো ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু বছরে সেটি বিশাল রূপ নেয়। এই ধারাবাহিক পরিবর্তনই প্রতিষ্ঠানকে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত করে এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে প্রতিষ্ঠিত করে। পরিশেষে শেষ করছি “ছোট পরিবর্তনে গড়ি বড় ভবিষ্যৎ” দিয়ে।।
লেখক : আবদুল আজিজ
হেড অব ইনোভেশন
ব্ল্যাকবেল্ট – লীন সিক্স সিগমা
কন্টেন রাইটার