
তরুণ মালিক বনাম পুরনো বলয়: বাংলাদেশের কর্পোরেট পরিবর্তনের অদৃশ্য যুদ্ধ ।
আমাদের দেশের কর্পোরেট জগতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম, নেতৃত্ব বদলানোর ধারা স্পষ্ট । বিশেষ করে RMG সেক্টরে গত এক দশকে অনেক তরুণ মালিক বসেছেন। নতুন উদ্যোক্তা এবং শিক্ষিত নতুন নেতৃত্ব ব্যবসা পরিচালনায় আরও আধুনিক। তারা ডেটা–ভিত্তিক, সিস্টেমেটিক ও প্রগতিশীল পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। লক্ষ্য—প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক মানে নেওয়া এবং অকার্যকর ব্যবস্থাপনা পরিবর্তে দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া। কিন্তু এত করেও কি আপনি মনে করেন আক্ষরিক কোন পরিবর্তন হচ্ছে। কতজন তিরুন মালিক পারছেন তার প্রতিষ্ঠানকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে? কেন পারছেন না? আপনি কি মনে করেন? আসুন আজকের ব্লগে এই কারণগুলোই খোজার চেষ্টা করবো। সাথে থাকবেন তো? চলুন দেখি কেন পরিবর্তন আসছে না।
বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোতে পরিবর্তন কেন আসে না?
অনেক তরুন মালিক পরিবর্তনের অনেক কিছু নিয়ে আসেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, পুরনো ধাঁচে চলছে সব কিছু । পরিবর্তন হয় খুব ধীরে, অনেক ক্ষেত্রে হয়ই না। তরুণ নেতৃত্ব সৎ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কেন দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়। ভাবুন তো কেন? আমি মনে নিচের পয়েন্টগুলো নিয়ে যদি আলোচনা করি তাহলে সম্ভাব্য কিছু কারন পেতে পারি?
- তরুণ মালিক বা নেতৃত্ব কেন “বলয়ের” ভেতরে আটকে যায়?
- কর্মীদের বড় অংশ পরিবর্তনকে কেন ভয় পায়?
- বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কীভাবে দক্ষতার ঘাটতি তৈরি করছে?
- সাংগঠনিক সংস্কৃতি কীভাবে পরিবর্তনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা?
- এবং পরিবর্তন সফল করতে কী ধরনের বাস্তব পদক্ষেপ প্রয়োজন?
তরুণ নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ: পুরনো বলয় বা চাটুকার গোষ্ঠী।
মনে করুন আপনার বাবার প্রতিষ্ঠানে আপনি নেতৃত্বে আসলেন। কিন্তু আপনার বাবার সময়ের অনেকেই তখনও থেকে যায়। আপনি ব্যবসার হাল ধরতেই চারপাশে হঠাৎ করে তারা “বিশ্বস্ত সিনিয়র” জড়ো হয়ে যাবে। আপনি চাইলেও এদের সরিয়ে দিতে পারবেন না, কারন এরা বিশ্বাসী? কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছেন? এরা বিশ্বাসী আর অভিজ্ঞ হলেও তাদের অভ্যাস ও মানসিকতা পুরনো। এদের কারণেই তরুন মালিকগন নানান সমস্যায় পড়েন। আসুন জানি এদেরে মধ্যে কি কি সমস্যাগুলো দেখা যায়।
তারা পরিবর্তনকে হুমকি হিসেবে দেখে।
তরুন মালিক,পুরোনো স্টাফদের কাছ থেকে প্রথমেই বাধাগ্রস্থ হন ”পরিবর্তনের””। পরিবর্তন মানে নতুন নতুন প্রযুক্তির আগমন পুরানো প্রযুক্তিকে বিদায়। স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, ডেটা–ভিত্তিক কাজ। দায়িত্ব স্পষ্ট হওয়া এবং কর্মদক্ষতার মূল্যায়ন। এতে সেই পুরনো কর্মীরা নিজেদের পজিশন হারানোর ভয় থাকে। তাই তারা নিজের অবস্থান রক্ষার জন্য তরুণ নেতৃত্বের মনোযোগ নিজেদের দিকে টেনে রাখে।
তরুণ মালিকদের অভিজ্ঞতার অভাব কাজে লাগানো হয়।
অনেক তরুণ মালিক নতুন ব্যবসায়। তারা সিনিয়রের পরামর্শে অতিরিক্ত নির্ভর করে। এতে তারা সহজেই ফাঁদে পড়ে। তবে এর থেকে বের হওয়া সম্ভব। পুরনো কর্মীরা প্রায়শই শুধু ফলাফল দেখান, কিভাবে হবে তা বলেন না। পুরো SOP দেয়া হয় না। উদাহরণস্বরূপ, কেউ বলল ৫ জনের কাজ ২ জনেই হবে যথেষ্ট। মালিকও তা বিশ্বাস করেন। SOP না থাকায় কাজ শূন্য হয়। এই শূন্যতা বড় বিপর্যয় ডেকে আনে। তাই নিজের বিশ্লেষণ ও কৌশল তৈরি করাই নিরাপদ পথ।
স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী পরিবর্তনকে থামিয়ে দেয়।
যাদের উপর তরুন মালিক নির্ভর করেন। তারা গোপনে প্রতিটি পরিবর্তনকে বাধা দেয়—
- নতুন প্রযুক্তি আসলে বিরোধিতা করে
- দক্ষ জনবল নিয়োগে নেতিবাচক মন্তব্য করে
- প্রক্রিয়া পরিবর্তনের উদ্যোগ অবমূল্যায়ন করে
- মালিককে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে
ফলে তরুণ নেতৃত্বের পরিবর্তনের স্বপ্ন কাগজেই আটকে থাকে।
কর্মীদের একটি বড় অংশ কেন পরিবর্তন চায় না
পরিবর্তন শুধু মালিকের ইচ্ছায় হয় না—এটি পুরো সংগঠনের মানসিকতা বদলে আনে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কর্মীদের অনেকেই পরিবর্তনকে স্বাগত জানায় না। কারণ:
নতুন শেখার ভয়: নতুন সিস্টেম মানে নতুন সফটওয়্যার, নতুন রিপোর্টিং, নতুন KPI, নতুন দায়িত্ব।
অনেক কর্মী শেখার পরিবর্তে “এতদিন যেমন চলছিল, তেমনই চলুক” মনোভাব ধারণ করেন।
দক্ষতা কম থাকায় স্বচ্ছতার ভয়: যখন ডেটা–ভিত্তিক কাজ শুরু হয়, তখন চাতুরী বা লুকোচুরি কমে যায়। অনেকে নিজের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার আতঙ্কে পরিবর্তনকে বাধা দেয়।
কমফোর্ট জোন থেকে বের হতে অনীহা: মানুষ সাধারণত পরিবর্তনকে ভয় পায়।
বিশেষ করে যখন:
বহু বছর একইভাবে কাজ করা
নিরাপদ চাকরির সংস্কৃতি
নতুন কিছু শিখতে অস্বস্তি
এসব মিলে পরিবর্তন প্রতিরোধ আরও প্রবল হয়।
দক্ষ জনবলের ঘাটতি: শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো দক্ষতা (skills)-এর চেয়ে তত্ত্ব (theory) ও পরীক্ষায় বেশি মনোযোগী। এর ফলে কর্মক্ষেত্রে তিনটি বড় সংকট দেখা যায়।
- সমস্যা সমাধান দক্ষতার ঘাটতি:অনেকে সিদ্ধান্ত-নির্ভর বা সমস্যা সমাধানমুখী কাজ করতে পারে না। সমস্যা গভীরে গিয়ে সমাধান বের করতে পারে এমন কর্মীর অভাব পরিবর্তনকে ধীর করে দেয়
- নেতৃত্বের সংকট—বিশেষ করে মিডল ম্যানেজমেন্টে:মিডল ম্যানেজমেন্টই পরিবর্তনের চালিকাশক্তি। কিন্তু এখানেই দক্ষতার সংকট সবচেয়ে বেশি।
- প্রযুক্তিতে দুর্বলতা: ERP, SOP, digital workflow, automation—এসবের ব্যবহার অনেকেই বোঝে না। ফলে পরিবর্তন বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়ে।
সাংগঠনিক সংস্কৃতি: পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় বাধা।
একটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি ২০–৩০ বছরে তৈরি হয়। এতে নেতিবাচক উপাদান থাকলে পরিবর্তন কঠিন হয়।
- দোষারোপ–নির্ভর পরিবেশ :অনেক জায়গায় ভুল হলে সমাধান নয়, মানুষ খোঁজা হয়। এতে কর্মীরা ঝুঁকি নিতে ভয় পায়।
- ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ:সব সিদ্ধান্ত ১–২ জনের হাতে থাকলে টিমওয়ার্ক হয় না। পরিবর্তন করতে গেলে decentralized decision-making অত্যন্ত প্রয়োজন।
- SOP ও সিস্টেমের অভাব:অনেক কোম্পানির প্রকৃত কোনো প্রক্রিয়া (process) নেই। যেখানে process নেই, সেখানে পরিবর্তন হয় “লোক বদলে”, সিস্টেম বদলে নয়।
- কথা বেশি, কাজ কম—এমন সংস্কৃতি:পরিবর্তন নিয়ে মিটিং হয়, আলোচনা হয়, কিন্তু execution হয় না। কারণ implementation culture দুর্বল।
তরুণ নেতৃত্বের ভুল বা সীমাবদ্ধতা।
আমরা অনেকেই তরেুন নেতৃত্যের ভুলগুলো নিয়ে সমালোচনা করি। কিন্তু সবগুলোই কি মালিকের দোষ? আমি বলবো না। কারণ তরুন মালিকদের কিছু বাস্তব সীমাবদ্ধতা আছে।
- Vision আছে, কিন্তু roadmap নেই: অনেক তরুণ মালিক জানেন কী করতে চান, কিন্তু কীভাবে করবেন তা স্পষ্ট নয়।
- পরিবর্তনের জন্য নিবেদিত টিম নেই:Change Management Team বা PMO না থাকায় কেউ পরিবর্তন নেতৃত্ব দেয় না।
- ডেটাভিত্তিক সিদ্ধান্তের অভাব:অনেক সিদ্ধান্ত আবেগ বা ধারণা থেকে নেওয়া হয়।
- যোগ্য লোক নিয়োগে আপোষ:যোগ্য লোক নিয়োগ মানেই বেশি বেতন—বেশিরভাগ কোম্পানি এতে অনীহা দেখায়।
তাহলে আসল সমস্যা কোনটি?
এই প্রশ্নের উত্তর আমি এক শব্দে বলবো সেটা হলো ইকোসিস্টেম। ইকোসিস্টেম হলো সাপ্লাই চেইন, উৎপাদন ইউনিট, ডিজাইনার, বায়ার, মান নিয়ন্ত্রণ, শ্রমিক এবং লজিস্টিকসের সমন্বিত পরিকাঠামো । প্রতিটি অংশ একে অপরের ওপর নির্ভর করে, যেন পোশাক উৎপাদন ও সরবরাহ প্রক্রিয়া মসৃণভাবে চলে এবং শিল্পের কার্যকারিতা বজায় থাকে। বাংলাদেশের কর্পোরেট সেক্টরে পরিবর্তন থমকে থাকে কারণ:
নেতৃত্ব
সংস্কৃতি
দক্ষতা
কর্মীমানসিকতা
সিস্টেম
শিক্ষা
সবকিছু একসঙ্গে কাজ করে। একটি অংশ উন্নত হলেও অন্য অংশ দুর্বল থাকলে পরিবর্তন সফল হয় না।
কিভাবে পরিবর্তন আনা সম্ভব? (সমাধান)
এই অবস্থার উত্তরণের পথ কি? হ্যাঁ অবশ্যই আছে, একটি পরিবর্তন সফল করতে তরুন মালিকদের কিছু পরিষ্কার পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
নেতৃত্বকে বলয়মুক্ত ও তথ্যনির্ভর হতে হবে: সিনিয়রিটির ওপর নয়, দক্ষতার ওপর গুরুত্ব। নিয়মিত পারফরম্যান্স রিভিউ। স্বার্থবাদী গোষ্ঠী শনাক্ত করে সিস্টেম বদল।
কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও মনোভাব পরিবর্তন।
- Continuous training
- Skill development
- কর্মীদের উদ্যোম বাড়াতে ইনসেনটিভ
SOP, Policy ও Process অটোমেশন: পরিবর্তন লোক দিয়ে হয় না—সিস্টেম দিয়েই করতে হয়।
মিডল ম্যানেজমেন্ট শক্তিশালী করা: মিডল ম্যানেজম্যান্ট হলো পরিবর্তনের প্রকৃত ইঞ্জিন। তাই এদের শক্তিশালী করতে হবে হয়, ট্রেইনআপের মাধ্যমে নয় পরিবর্তন করে।
ধাপে ধাপে পরিবর্তন
Big-bang transformation নয়।
“Small wins → Big change”
উপসংহার ।
বাংলাদেশের অনেক তরুণ মালিক সত্যিকারের পরিবর্তন চান। কিন্তু পরিবর্তন যখন একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া, তখন শুধু ইচ্ছা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন—
- দক্ষ টিম
- স্বচ্ছ সিস্টেম
- আধুনিক সংস্কৃতি
- শেখার পরিবেশ
এবং স্বার্থান্বেষী বলয় থেকে বেরিয়ে আসার সাহস । যে প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দূরদর্শী এবং কর্মীরা শেখার জন্য প্রস্তুত—সেখানেই উন্নয়ন নিশ্চিত, পরিবর্তন ধারাবাহিক এবং সাফল্য স্থায়ী হয়। বাংলাদেশ এই পরিবর্তনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। এখন প্রয়োজন বাস্তবায়নের দৃঢ়তা। আপনি কি আমার সাথে একমত ? যদি একমত হন দয়া ব্লগটি শেয়ার করুন।
আবদুল আজিজ
হেড অব স্যাম্পল এন্ড ইনোভেশন ।
