Rich Dad Poor Dad: একটি বই, একটি দর্শন, একটি জীবন বদলের দিক-নির্দেশনা।

ভূমিকা:
“Rich Dad Poor Dad” একটি বই, একটি দর্শন, একটি জীবনবদলের দিকনির্দেশনা । বইটি রবার্ট টি. কিয়োসাকি লিখিত এক অসাধারণ ব্যক্তিগত আর্থিক শিক্ষার গ্রন্থ। বই পড়ে মানুষের জ্ঞান, চিন্তাশক্তি ও মননশীলতা বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি কেবল তথ্য দেয় না, বরং মানসিক প্রশান্তি, শব্দভাণ্ডার ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা বাড়ায়। বই পড়ার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন মানুষের অভিজ্ঞতা, সংস্কৃতি ও জীবনদর্শন জানতে পারি যা আমাদের চিন্তার পরিধি বাড়ায়। আমাদের প্রতিনিয়ত এমন কিছু বই পড়া উচিৎ যা শুধু পরীক্ষার জন্য নয়, জ্ঞান ও মূল্যবোধ গঠনের জন্যও জরুরি। জীবনের প্রতিটি ধাপে, আপনি যখন আত্মউন্নয়ন, অনুপ্রেরণা বা জ্ঞানের খোঁজে থাকবেন তখন বই পড়া সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। আজকের এই ব্লগে তেমনি জীবন পরীবর্তনকারী বই নিয়ে কথা বলবো এর মোটিভেশন মুলক আরো কিছু পড়তে দয়া করে ভিজিট করুন।
কেন Rich Dad Poor Dad গুরুত্বপূর্ণ:
“Rich Dad Poor Dad” বইটিতে লেখক দুই ধরনের চিন্তাধারা ও জীবনদর্শনকে তুলে ধরেছেন—একজন হচ্ছেন তার নিজের পিতা (পুওর ড্যাড) এবং অপরজন তার বন্ধুর পিতা (রিচ ড্যাড)। পুওর ড্যাড একজন শিক্ষিত সরকারি কর্মচারী, আর রিচ ড্যাড একজন স্বশিক্ষিত, কিন্তু সফল ব্যবসায়ী। এই দুই পিতার জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গির তুলনার মাধ্যমে রবার্ট আমাদের শেখান কীভাবে আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন করা যায়, কেন স্কুলের শিক্ষা সবকিছু নয় এবং অর্থ সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্লগে আমরা বিশ্লেষণ করব এই বই থেকে আমাদের কী কী শিক্ষণীয় (lessons) এবং অনুকরণীয় (admirable) দিক রয়েছে, যা বাস্তব জীবনে কাজে লাগিয়ে আমরা আর্থিকভাবে সচেতন ও স্বাধীন হতে পারি।
অর্থের জন্য কাজ নয়, অর্থকে নিজের জন্য কাজ করানো।
আমরা জানি মানুষ সারাজীবন অর্থের জন্য কাজ করে । কিন্তু এই বইটির মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম যে, মানুষ সারাজীবন অর্থের জন্য কাজ করে, অথচ ধনী মানুষ অর্থকে তাদের জন্য কাজ করায়। বইটির অন্যতম প্রধান শিক্ষা হলো—সাধারণ অর্থাৎ, পুওর ড্যাড যেভাবে চাকরির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের উপর নির্ভর করতেন । কিন্তু রিচ ড্যাড উল্টোভাবে চিন্তা করতেন—তিনি বলতেন, “Don’t work for money. Make money work for you. তাই আমাদের উচিত এমন দক্ষতা অর্জন করা, যার মাধ্যমে আমরা নিজেই আয় সৃষ্টির উৎস তৈরি করতে পারি। বিনিয়োগ, ব্যবসা, প্যাসিভ ইনকামের মতো কৌশলগুলো শেখা এবং প্রয়োগ করাও অনুকরণীয়। এভাবেই আমরা ভবিষ্যতে আর্থিক নিরাপত্তা অর্জন করতে পারি।
আর্থিক শিক্ষা স্কুলে শেখানো হয় না:
আমরা যখন স্কুলে পড়ি তখন আমাদের কি শিখিয়েছে? কিছু নির্ধারিত পাঠ্যসূচি এবং তার উপর লিখিত এবং মৌখিক পরিক্ষা । আপনি স্কুলে কখনো কি শিখিছেন ভালো অর্থ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে? না বরং স্কুল আমাদের ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য প্রস্তুত করে, কিন্তু ভালো অর্থ ব্যবস্থাপনার শিক্ষা দেয় না। কিয়োসাকি বলেন, “We are taught to be employees, not employers.” এ থেকে বোঝা যায়, বাস্তব আর্থিক জ্ঞান, যেমন—আয়, ব্যয়, সম্পদ, দেনা, ক্যাশ ফ্লো ইত্যাদি বিষয় স্কুলের পাঠ্যক্রমে নেই। আমরা নিজেরা স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারি—বই পড়ে, কোর্স করে, অভিজ্ঞদের কাছ থেকে শিখে। প্রত্যেকের উচিত নিজের আর্থিক শিক্ষা শুরু করা এবং সন্তানদেরও তা শেখানো।
সম্পদ এবং দায়বদ্ধতার মধ্যে পার্থক্য কি ?
আমরা একটি বিষয় কিন্তু স্পষ্টভাবে অনেকেই বুঝি সেটা হলো কোন আমাদের সম্পদ আর কোনটা দায় । যদি প্রাইভেট অর্গানাইজেশনের উদহারণ দেই তাহলে বুঝবেন কোন লোকটি কোম্পানীর জন্য দায় আর কোন লোকটি সম্পদ এটা কোম্পানী দ্রুত বুঝেন তারা ততই দ্রুত উন্নত করেন । কি একটু বুঝতে কষ্ট হচ্ছে তাহলে খুলে বলি । একটি বিনিয়োগ ফ্ল্যাট যা ভাড়া আয় দেয় সেটি সম্পদ আর পক্ষান্তরে একটি ব্যক্তিগত গাড়ি, যার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ আছে, সেটি দায়।
Rich Dad Poor Dad বইটিতে বলা হয়েছে, ধনীরা সম্পদ (assets) কিনে, আর গরিব ও মধ্যবিত্তরা দায় (liabilities) কিনে ভেবে বসে তারা সম্পদ কিনেছে। একটি সম্পদ এমন কিছু যা আপনার পকেটে অর্থ আনে, আর দায় এমন কিছু যা অর্থ বের করে নিয়ে যায়। সম্পদের দিকে মনোযোগ দেওয়া এবং দায়বদ্ধতা সীমিত করাই সঠিক পথ। আমাদের উচিত এমন সম্পদ তৈরি করা—যেমন: ভাড়ার ফ্ল্যাট, ব্যবসা, স্টক, ডিভিডেন্ড ইত্যাদি, যা দীর্ঘমেয়াদে আয় দেবে।
চাকরি মানেই নিরাপত্তা নয়, বরং ব্যবসা ও বিনিয়োগই ভবিষ্যত:
আমার মত অনেকেই মনে করেন যে চাকরী হলো একটা নিরাপত্তার স্থান। কারণ মাস হলেই অর্থ আসবে যার মাধ্যমে সকল কিছুর সমাধান হবে । আর ব্যবসা হলো একটি ঝুকির কাজ যেকোন সময় ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অথচ Rich Dad Poor Dad বইটির মাধ্যমে আপনি জানবেন চাকরি আপনাকে সময়ের বিনিময়ে অর্থ দেয়। কিন্তু আপনি যদি না থাকেন বা অসুস্থ হন, আয় বন্ধ হয়ে যাবে। ধনীরা তাই ব্যবসা ও বিনিয়োগে গুরুত্ব দেন, যা চলতে পারে তার উপস্থিতি ছাড়াও।
নিজস্ব ব্যবসা গড়ে তোলা, স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ, রিয়েল এস্টেট বা ডিজিটাল অ্যাসেট নির্মাণের মাধ্যমে আমরা প্যাসিভ ইনকাম গড়ে তুলতে পারি। এতে করে জীবনের যেকোনো পর্যায়ে আমরা স্বাধীন থাকতে পারি।
ভয় ও সন্দেহ থেকে বেরিয়ে এসে সাহসিক সিদ্ধান্ত নেওয়া:
আমি দীর্ঘদিন একই কোম্পানীতে কাজ করছি, নিজের কি যোগ্যতা আছে তা কখনো প্রমাণের সুযোগ নেই নাই । তাই নিজেকে তেমনভাবে মেলে ধরতে পারিনি। শুধু আমি না অঅমার মত এরকম অনেকেই আছেন যারা ভয় ও সন্দেহ থেকে বেরিয়ে আসতে সাহস পান না। কিন্ত বইটিতে আমাদের শিখিয়েছে “Fear is part of the process. Don’t let it stop you.” ব্যবসা বা বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকে, তবে সঠিক জ্ঞান ও পরিকল্পনা থাকলে সফলতা সম্ভব। আমাদের উচিত ভয়ের কারণে থেমে না থেকে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে সাহসিক পদক্ষেপ নেওয়া।
অর্থ উপার্জনের জন্য নয়, শেখার জন্য কাজ করো:
জীবনে টিকে থাকতে অর্থের প্রয়োজন অনস্বীকার্য । শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্য কাজ করলে আমরা অস্থায়ী লাভ পাই, স্থায়ী উন্নতি নয়। শেখার উদ্দেশ্যে কাজ করলে আমরা নতুন দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অর্জন করি যা ভবিষ্যতে অনেক গুণ বেশি মূল্যবান হয়ে দাঁড়ায়। রবার্ট বলেন, “Work to learn, not to earn.” চাকরি বা কাজ শুধু আয়ের জন্য নয়, শেখার সুযোগ হিসেবেও গ্রহণ করা উচিত। যেমন, বিক্রয়, যোগাযোগ, নেতৃত্ব, হিসাব ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা।
যে কোনো কাজে আমরা যদি শেখার মানসিকতা নিয়ে যুক্ত হই, তাহলে তা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য বড় সম্পদ হয়ে উঠবে। শেখার জন্য বিনিয়োগ করাও একধরনের স্মার্ট বিনিয়োগ। একজন সত্যিকারের সফল মানুষ জানেন, শেখা একটি চলমান প্রক্রিয়া। কাজ শেখার জন্য করলে নিজেকে আপগ্রেড করা যায় এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আয়ের পথও অনেক প্রশস্ত হয়। তাই শুধু টাকা নয়, প্রতিটি কাজকে শেখার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করাই হলো দীর্ঘমেয়াদে সাফল্যের চাবিকাঠি।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব ।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা মানে নিজের আবেগ, চিন্তা ও কাজকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা। এটি এমন একটি শক্তি যা মানুষকে তাৎক্ষণিক আবেগ বা প্রলোভনের বদলে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের পথে রাখে। বইটিতে আমরা দেখতে পাই পুওর ড্যাড সবসময় আয় বাড়ানোর চেষ্টা করতেন, কিন্তু খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি সক্ষম ছিলেন না । আবার রিচ ড্যাড শেখান, অর্থ আসার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো অর্থ ধরে রাখা ও নিয়ন্ত্রণ করা। আত্মনিয়ন্ত্রণ মানুষকে ধৈর্যশীল, সংযত ও চিন্তাশীল করে তোলে। যখন কেউ রাগ, হতাশা বা লোভের মধ্যে পড়ে নিজেকে সামলে নিতে পারে, তখন সে ভুল সিদ্ধান্ত এড়িয়ে সঠিক পথ বেছে নিতে সক্ষম হয়। নিজের বাজেট তৈরী করুন, অপ্রয়োজনীয় খরচ কমান, এবং সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলুন । এসব আমাদের জীবনে বাস্তবভাবে অনুকরণীয় ও উপকারি অভ্যাস। ছাত্রজীবনে পড়ালেখায় মনোযোগ ধরে রাখা, কর্মজীবনে সময়ের সঠিক ব্যবহার, কিংবা পারিবারিক জীবনে সম্পর্ক রক্ষা—সবকিছুতেই আত্মনিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য।
সমস্যা থেকে পালিয়ে নয়, সমাধান খোঁজো।
Rich Dad বলতেন, “The size of your success is measured by the strength of your desire and how you handle disappointment.” — অর্থাৎ, তোমার সাফল্য নির্ধারিত হয় তোমার ইচ্ছাশক্তি এবং তুমি কীভাবে হতাশাকে মোকাবিলা করো তার ওপর। জীবনে যখন আমরা সমস্যার সম্মুখীন হই, তখন পালিয়ে না গিয়ে সেই সমস্যার গভীরে গিয়ে বুঝে নেওয়া উচিত, কী শেখা যায় এবং কীভাবে সামনে এগোনো যায়। কারণ প্রতিটি সমস্যা আমাদের জন্য একটি নতুন শিক্ষার দরজা খুলে দেয়। অর্থনৈতিক বা ব্যক্তিগত সংকটে পড়লে আমরা প্রায়শই হতাশ হই। কিন্তু সফল ব্যক্তিরা জানেন—সমস্যা হলো সম্ভাবনার ছদ্মবেশ। তাই আমাদের উচিত মনোবল ধরে রেখে সমস্যার কারণ বিশ্লেষণ করা, বিকল্প পথ খোঁজা, এবং প্রয়োজন হলে নতুন কিছু শেখা ও প্রয়োগ করা। কারণ সমস্যা থেকেই সমাধানের জন্ম হয়। এটি আমাদের উন্নতির অন্যতম চালিকাশক্তি।
শিশুকাল থেকেই আর্থিক শিক্ষার সূচনা।
Rich Dad Poor Dad বইটিতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, যেভাবে শিশুরা স্কুলে অক্ষরজ্ঞান শেখে, সেভাবেই তাদের আর্থিক শিক্ষাও ছোটবেলা থেকেই দিতে হবে। ধনী পিতারা শিশুদের কেবল পড়ালেখার ওপর নয়, অর্থ ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগ, সম্পদ গঠন ও দায়-সম্পদের পার্থক্য সম্পর্কেও শিক্ষা দেন। কারণ, আর্থিক সচেতনতা জীবনের একটি অপরিহার্য দক্ষতা, যা ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদেরও উচিত শিশুদের ছোটবেলা থেকেই অর্থ ব্যবস্থাপনায় অভ্যস্ত করে তোলা। যেমন—পিগি ব্যাংক ব্যবহার, সাপ্তাহিক খরচের বাজেট তৈরি, অপ্রয়োজনীয় খরচ না করা, সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা ইত্যাদি। খরচ ও সঞ্চয়ের মধ্যে পার্থক্য বোঝানো গেলে শিশুরা শিখবে কীভাবে টাকা কাজ করায়, না যে শুধু টাকার জন্য কাজ করতে হয়। এভাবেই গড়ে উঠবে একটি আত্মনির্ভরশীল ও আর্থিকভাবে সচেতন প্রজন্ম।
উপসংহার ।
“Rich Dad Poor Dad” বইটি কেবল একটি আর্থিক নির্দেশিকা নয়, এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের পথপ্রদর্শক। বইটি আমাদের শেখায় কীভাবে প্রচলিত বিশ্বাসের বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে হয়, এবং অর্থের সাথে আমাদের সম্পর্ককে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করতে হয়। পুওর ড্যাড আমাদের দেখান প্রচলিত শিক্ষা ও জীবনের সীমাবদ্ধতা, আর রিচ ড্যাড দেখান স্বাধীনতা ও বিকল্প পথের দিশা।
এখানে যে শিক্ষাগুলি আমরা পেলাম—সেগুলো শুধু আমাদের আর্থিক অবস্থাকে উন্নত করতে সাহায্য করে না, বরং জীবনদর্শন, ঝুঁকি নেওয়া, এবং ভবিষ্যতের প্রতি দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গিও গড়ে তোলে। তাই বইটির শিক্ষাগুলো আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরে অনুকরণীয় এবং প্রাসঙ্গিক।
লেখক : আবদুল আজিজ
কন্টেন্ট রাইটার