চাকরির দীর্ঘস্থায়িত্ব, প্রজ্ঞার প্রকাশ না প্রগতির প্রতিবন্ধকতা?

চাকরির দীর্ঘস্থায়িত্ব, এটা প্রজ্ঞার প্রকাশ না প্রগতির প্রতিবন্ধকতা?আমাদের চারপাশে অনেকেই আছেন যারা দীর্ঘদিন ধরে একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন—২০, এমনকি ৩০/৩৫ বছর পর্যন্ত। আমি নিজেই এমন একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি যেখানে এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। প্রশ্ন হলো—তারা কেন এত দীর্ঘ সময় এক জায়গায় আছেন? একপক্ষে বলা হয়, এটি দায়িত্ববোধ, লয়ালটি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি আত্মিক সংযুক্তির নিদর্শন। অন্যপক্ষে কেউ কেউ মনে করেন, এটি অযোগ্যতা, স্থবিরতা কিংবা আত্মবিশ্বাসের ঘাটতির প্রতিফলন। কেউ বলেন, “ভালো হলে তো অন্য কোথাও চাকরি পেতো,” আবার কেউ মনে করেন, “এত বছর টিকে থাকা মানেই তিনি প্রতিষ্ঠানটির মূল চালিকাশক্তি।”
এই দ্বন্দ্ব ও বিতর্ক নিয়েই আজকের ব্লগে আমরা খুঁজে দেখবো—দীর্ঘস্থায়ী কর্মজীবনের পেছনের বাস্তবতা, প্রজ্ঞা এবং প্রগতির সম্পর্ক। এমন আরও ভাবনাপ্রবণ ও বাস্তব অভিজ্ঞতামূলক আলোচনা পেতে ভিজিট করুন আমাদের ব্লগে।
চাকরির দীর্ঘস্থায়িত্ব একই কর্মসংস্থানে নির্বুদ্ধিতা না স্মার্ট চিন্তাধারা।
একই কর্মসংস্থানে চাকরির দীর্ঘস্থায়িত্ব একপাক্ষিকভাবে নির্বুদ্ধিতা বা শুধুই স্মার্ট চিন্তা—এই দুইয়ের কোনো একটি বলা ঠিক নয়। আমি মনে করি, বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করে আপনি সেই প্রতিষ্ঠানে কী শিখেছেন, কীভাবে মূল্য সংযোজন করেছেন এবং প্রতিষ্ঠানের বিকাশে কতটা অবদান রেখেছেন তার উপর। যদি আপনি একই জায়গায় থেকে ধারাবাহিকভাবে দক্ষতা বাড়াতে পারেন, নেতৃত্বের গুণ অর্জন করেন এবং দায়িত্বের পরিধি বাড়িয়ে তোলেন—তবে নিঃসন্দেহে এটি একটি মূল্যবান অভিজ্ঞতার ফল।
তবে যাঁরা মনে করেন, “এতদিন আছি, সব কিছু জানি, নতুন কিছু শেখার আর প্রয়োজন নেই”—এমন ‘ফিক্সড মাইন্ডসেট’ ধরে রাখা সত্যিই নির্বুদ্ধিতা। কারণ সময়ের সঙ্গে না বদলালে, স্থবিরতা আপনার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। তাই দীর্ঘস্থায়ীতার প্রকৃত মানদণ্ড হওয়া উচিত—নতুন শেখা, ক্রমাগত উন্নয়ন ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মানিয়ে চলার সক্ষমতা।
চাকরির দীর্ঘস্থায়িত্বের পর কখন প্রতিষ্ঠান থেকে মন সরে নেয়?”
একই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন কাজ করার পর কর্মীদের মাঝে যখনই স্বীকৃতির অভাব, উন্নতির অচলাবস্থা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণের সুযোগ হারিয়ে যায়, তখনই তারা ধীরে ধীরে আস্থা হারাতে শুরু করেন। যেমন ধরুন, রফিকুল ইসলাম নামের একজন কর্মী ১৮ বছর ধরে একই গার্মেন্টসে কাজ করছেন। অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কখনোই সেকশন ইনচার্জ হতে পারেননি। প্রতিবছর নতুন কেউ এসে তার ওপর বস হয়ে যায়। এতে তার ভেতরে হতাশা জন্ম নিয়েছে। তার দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ নয়, কিন্তু নেতৃত্বের স্বচ্ছতার অভাবে তার আত্মবিশ্বাস ও কর্মপ্রেরণা কমে গেছে। এভাবে, যখন কর্মীদের মূল্যায়ন হয় না এবং কাজের কোনও অর্থপূর্ণ প্রতিফলন দেখা যায় না, তখন আস্থার জায়গা ভেঙে পড়ে। আস্থা ধরে রাখতে হলে স্বীকৃতি, উন্নয়ন ও সম্মান—এই তিন উপাদান নিশ্চিত করতেই হবে।
দীর্ঘদিন একই কর্মসংস্থানে কাজ করার পর কখন চাকরী ছাড়ার চিন্তা করা হয়।
একই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘসময় কাজ করার পর চাকরি ছাড়ার চিন্তা সাধারণত তখনই মাথায় আসে, যখন কর্মী অনুভব করে যে তার দক্ষতা আর বিকশিত হচ্ছে না, কাজের স্বীকৃতি মিলছে না, কিংবা একই ধরনের দায়িত্ব বারবার করতে করতে সে মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এছাড়া কর্মপরিবেশ বিষাক্ত হলে, নেতৃত্বে আস্থা নষ্ট হলে কিংবা আর্থিক ও পেশাগত উন্নতির কোনো দৃশ্যমান পথ না থাকলে, অনেকেই নতুন সুযোগের খোঁজে প্রতিষ্ঠানে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন।
দীর্ঘসময়ের আস্থাবান লোকদের হারালে কোম্পানী কি আদৌ ক্ষতিগ্রস্থ হয়?
দীর্ঘদিন একই কর্মসংস্থানে কাজ করা আস্থাবান ও অভিজ্ঞ কর্মীদের হারানো প্রতিষ্ঠানটির জন্য কখনো ভালো দিক হতে পারে না। কারণ তাদের সংগৃহীত প্রতিষ্ঠানজ্ঞান, প্রক্রিয়া, ক্লায়েন্ট, উৎপাদন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাদের গভীর ধারণা ছিল। পক্ষান্তরে স্ট্যাবিলিটি ও নেতৃত্ব নতুন কর্মীদের জন্য তারা ছিল মেন্টর ও নির্ভরতার জায়গা হতে পারেতো। আবার লয়ালটি ও কমিটমেন্ট দীর্ঘদিনের বিশ্বাসযোগ্যতা হঠাৎ বদলে যাওয়া কর্মপরিবেশে নেতিবাচক বার্তা দিতে পারে। তাই এমন কর্মীদের ধরে রাখতে না পারা প্রতিষ্ঠানিক দুর্বলতার ইঙ্গিতও হতে পারে।
চাকরির দীর্ঘস্থায়িত্বের সাথে কি ধরনের দক্ষতা অর্জন করা উচিৎ?
দীর্ঘদিন একই কর্মসংস্থানে কাজ করার পর একজন চাকরিজীবীর উচিত নিজেকে বহুমাত্রিকভাবে দক্ষ করে তোলা, যাতে তিনি প্রতিষ্ঠান ও নিজের ক্যারিয়ার—উভয়ের জন্য মূল্যবান হয়ে উঠতে পারেন। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা দেওয়া হলো:
- নেতৃত্ব ও টিম ম্যানেজমেন্ট : সহকর্মীদের পরিচালনা, অনুপ্রেরণা দেওয়া ও দলগত লক্ষ্যে নেতৃত্ব দেওয়া।
- সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা: জটিল পরিস্থিতিতে দ্রুত, বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকর সমাধান দিতে পারা।
- যোগাযোগ দক্ষতা (Communication Skills): লিখিত ও মৌখিক—উভয় ক্ষেত্রেই পরিষ্কার ও প্রভাবশালীভাবে মত প্রকাশ করা।
- ডেটা অ্যানালাইসিস ও রিপোর্টিং স্কিল: সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করার জন্য তথ্য বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন।
- টেকনোলজিক্যাল আপডেটেড থাকা: নতুন সফটওয়্যার, অটোমেশন বা ইন্ডাস্ট্রি রিলেটেড ডিজিটাল টুলসে দক্ষতা।
- স্ট্র্যাটেজিক থিংকিং ও প্ল্যানিং: শুধু দৈনন্দিন কাজ নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করা।
- ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স (EI): নিজের ও অন্যের আবেগ বুঝে সম্পর্ক উন্নয়ন ও সংকট ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা।
- ক্রস-ডিপার্টমেন্ট কাজ শেখা: নিজের বিভাগের বাইরে অন্য বিভাগেও কাজের ধারণা ও অভিজ্ঞতা অর্জন
দীর্ঘ ক্যারিয়ার, এক অফিস: আপনি স্মার্ট নাকি স্রোতে গা ভাসানো কর্মী?
একই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন কাজ করাকে কেউ দেখে স্থিরতা ও প্রজ্ঞার নিদর্শন হিসেবে, আবার কেউ ভাবে এটি আত্মতুষ্টি বা সাহসের অভাব। উদাহরণস্বরূপ, জামাল সাহেব ২৫ বছর ধরে একই কোম্পানিতে আছেন। শুরু করেছিলেন জুনিয়র অফিসার হিসেবে, কিন্তু আজও ম্যানেজার পদে উঠতে পারেননি। তিনি বলেন, “এখানে নিরাপত্তা আছে, তাই থাকছি।” অথচ তার কম অভিজ্ঞ অনেকেই এখন উচ্চ পদে বহুজাতিক কোম্পানিতে। প্রশ্ন হলো—তিনি কি স্মার্ট যে নিরাপদ জায়গায় থেকে গেছেন, নাকি তিনি স্রোতের সঙ্গে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন, যেখানে না আছে চ্যালেঞ্জ, না আছে বিকাশ? স্মার্ট হওয়া মানে এক জায়গায় থাকলেও নিজেকে আপডেট রাখা, নতুন স্কিল শেখা, ও প্রতিষ্ঠানে প্রভাব ফেলতে পারা। আর শুধু সময় পার করাই যদি লক্ষ্য হয়, তবে সেটি স্মার্ট ক্যারিয়ার নয়—স্থবিরতার ফাঁদ।
চাকরি বদলাই না থাকি: দীর্ঘস্থায়ীতার মানে কী?”
একই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন কাজ করা মানেই কি সফলতা? না কি এটি ভয়ের, অলসতা বা অনিশ্চয়তার প্রকাশ? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে আপনি সেই সময়টিকে কীভাবে ব্যবহার করেছেন তার উপর। কেউ কেউ ১৫-২০ বছর এক প্রতিষ্ঠানে থেকে প্রতিনিয়ত নিজেকে উন্নত করেছেন, দায়িত্ব নিয়েছেন, নেতৃত্ব গড়েছেন—যা অবশ্যই দীর্ঘস্থায়ীতার একটি সফল উদাহরণ। আবার কেউ শুধু নিরাপত্তার আশায় একই স্থানে আটকে থাকেন, নতুন কিছু শেখেন না, চ্যালেঞ্জ নেন না—এমন দীর্ঘস্থায়ীতার কোনো মূল্য নেই।
যেমন, আমার কোম্পানীতে এমন অনেক কেই দেখেছি যারা দীর্ঘদিন আছেন, প্রতিটি পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন, একাধিক বিভাগে দক্ষতা অর্জন করেছেন। আবার অনেকেই সমান সময় ধরে , কিন্তু আজও তার কাজ একই জায়গায়, একই ধাঁচে। সুতরাং, চাকরি বদলানো না বদলানো নয়, বরং আপনি কি প্রতিনিয়ত নিজেকে বদলাচ্ছেন, সেটাই দীর্ঘস্থায়ীতার প্রকৃত মানে।
দীর্ঘস্থায়ী চাকরি নাকি দ্রুত গ্রোথ? তরুণদের কী করা উচিত?”
বর্তমান যুগের তরুণদের অনেকেই বিশ্বাস করেন, ক্যারিয়ার গড়তে হলে বারবার চাকরি বদলানো দরকার। অন্যদিকে, অনেকেই মনে করেন, একটি প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন থাকা মানেই স্থিতিশীলতা ও অভিজ্ঞতা। আসলে, তরুণদের উচিত এই দুই চিত্রের মাঝখানে ভারসাম্য তৈরি করা। যেখানে শেখার সুযোগ, নেতৃত্বে ওঠার রাস্তা, দক্ষতা বাড়ানোর পরিবেশ এবং মূল্যায়নের স্বচ্ছতা আছে—সেই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ সময় থাকা যৌক্তিক ও লাভজনক। তবে যদি দেখা যায় কাজ শুধুই রুটিন মাফিক, শেখার বা এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, তখন ভেবে দেখা উচিত নতুন কোনো দিগন্তের কথা। তরুণদের উচিত—নিজেকে ক্রমাগত উন্নত করা এবং যে প্রতিষ্ঠানে সে উন্নয়ন সম্ভব, তাতেই দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া।
দীর্ঘস্থায়ী কর্মী প্রকৃত সম্পদ:
একজন কর্মী যখন দীর্ঘদিন একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তখন তিনি শুধু অভিজ্ঞ নন—প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি, কার্যপ্রবাহ ও ক্লায়েন্ট সম্পর্কেও গভীরভাবে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন। তাই এমন কর্মীদের ধরে রাখা মালিকদের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের কর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন করা, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার সুযোগ তৈরি করা এবং স্বীকৃতি দিয়ে অনুপ্রাণিত করা। যেমন, সময়মতো পদোন্নতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণের সুযোগ, স্কিল ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং এবং পারফরমেন্স বোনাস দেওয়া যেতে পারে।
যেমন, একটি গার্মেন্টসে ২০ বছর ধরে কাজ করছেন একজন সিনিয়র মেশিন অপারেটর, যিনি নতুনদের প্রশিক্ষকও। যদি তাকে যথাযথভাবে সম্মান না দেওয়া হয়, তাহলে তার বিদায় শুধু দক্ষতা হারানো নয়, নতুন কর্মীদের জন্যও হতাশার বার্তা হতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী কর্মী ধরে রাখাই প্রতিষ্ঠানের স্থায়িত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতার বড় চাবিকাঠি।
উপসংহার:
দীর্ঘস্থায়িত্ব: স্থবিরতা নয়, হোক সচেতন অগ্রগতি। চাকরির দীর্ঘস্থায়িত্ব এক জটিল এবং বহুস্তরবিশিষ্ট বাস্তবতা। এটি একদিকে যেমন আস্থাবান, অভিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত কর্মীর প্রতিচ্ছবি হতে পারে, অন্যদিকে অচলতা, নিরাপত্তার আবেগ ও পরিবর্তনের ভয় থেকেও জন্ম নিতে পারে। তাই দীর্ঘদিন এক কর্মস্থলে থাকাটাই সফলতা বা ব্যর্থতার চূড়ান্ত মাপকাঠি নয়। বরং কর্মীর দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা, দায়িত্বে বৈচিত্র্য, সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা এবং প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিতে তার সক্রিয় অংশগ্রহণই স্থায়ীতার প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করে। এই যুগে স্মার্ট ক্যারিয়ার মানে শুধুই চাকরি বদল নয়, বরং যেখানে থাকছেন, সেখানে প্রতিনিয়ত নিজেকে রিফাইন করে নতুন কিছু শেখা ও প্রভাব সৃষ্টি করা। স্থায়ীতার মানে হোক—নির্ভরতার সঙ্গে অগ্রগতির চলমান গল্প।
লেখক: আবদুল আজিজ
হেড অব স্যাম্পল এন্ড ইনোভেশন ।