
ভমিকা:
টাইম ম্যানেজম্যান্ট বই রিভিও ও আলোচনায় আজকের পর্বে আবদুল আজিজ- রচিত টাইম ম্যানেজম্যান্ট বইয়ের পর্যালোচনা করবো। যার মুল বিষয় হলো সময় নয়, অগ্রাধিকার ব্যবস্থাপনা। মানে সময় সবার সমান। কিন্তু যিনি সময় নয়, কোন কাজটা আগে করা জরুরি, সেটা ঠিক করেন — তিনিই প্রকৃত টাইম ম্যানেজার।” আমরা সবাই দিনে ২৪ ঘণ্টাই পাই। কেউ এই সময় দিয়ে অসাধারণ কিছু করে, আবার কেউ ব্যস্ত থেকেও কিছুই করতে পারে না। তাহলে পার্থক্য কোথায়? পার্থক্য সময় ব্যবস্থাপনায় নয়, অগ্রাধিকার ব্যবস্থাপনায়। যিনি জানেন কোন কাজটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এবং কোনটা অপেক্ষা করতে পারে — তিনিই সময়কে কাজে লাগাতে পারেন সঠিকভাবে। ব্যস্ততা মানেই বেশী উৎপাদন নয়। প্রতিদিন অসংখ্য কাজ, কল, মেসেজ আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে চায়। তখনই প্রয়োজন স্থির থাকা, এবং ঠিক করা – আজকের আসল কাজ কী? প্রত্যেক সকালে নিজেকে প্রশ্ন করুন। কিন্তু আপনার টাইম ম্যানেজম্যান্ট কাজে লাগাতে, জানুন কোন কাজটি করলেই সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হবে?” এই একটাই প্রশ্ন আপনার দিন, সপ্তাহ, এমনকি জীবন বদলে দিতে পারে।
টাইম ম্যানেজম্যান্টের ছন্দে সফলতার সুর:
সময়, একটি নিরব অথচ শক্তিশালী সম্পদ। এটি কখনো অপেক্ষা করে না, ফিরে আসে না, কিন্তু যারা সময়কে ঠিকঠাক ব্যবহার করতে জানে—তাদের জীবনে তৈরি হয় সাফল্যের নতুন দিগন্ত। আবদুল আজিজ তার “টাইম ম্যানেজমেন্ট” গ্রন্থে অত্যন্ত গুছিয়ে, প্রাঞ্জল ভাষায়, বাস্তব জীবনভিত্তিক উদাহরণ ও মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সময় ব্যবস্থাপনার পূর্ণাঙ্গ চিত্র এঁকেছেন। বইটিতে লেখক সময় ব্যবস্থাপনার মৌলিক ধারণা তুলে ধরেছেন—এটি কেবল ঘড়ি দেখে কাজ করা নয়, বরং সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করা। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে উৎপাদনশীলতার রূপরেখা দাঁড়ায় কার্যকর সময় ব্যবস্থাপনার ভিত্তির ওপর। আত্মবিশ্বাস ও ইতিবাচক মনোভাবের গুরুত্বও উঠে এসেছে, যেখানে মনোবিজ্ঞানের শক্তি সময়ের সদ্ব্যবহারকে অনুপ্রাণিত করে।
টাইম ম্যানেজম্যান্ট:মিথভাঙা ও লক্ষ্য নির্ধারণের কৌশল:
টাইম ম্যানেজমেন্ট মানে শুধু ব্যস্ত থাকা নয়, সঠিক কাজকে সঠিক সময়ে করা। অনেকেই মনে করেন সময় নেই — আসলে নেই স্পষ্ট অগ্রাধিকার। এই মিথ ভেঙে সফল হতে চাইলে প্রয়োজন বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ এবং তা ভাগ করে নেওয়া ছোট ছোট পদক্ষেপে। সময় নিয়ন্ত্রণ নয়, নিজের লক্ষ্য ও সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণই হলো প্রকৃত টাইম ম্যানেজমেন্টের কৌশল। এখানে তিনি সময় ব্যবস্থাপনাকে ঘিরে ১০টি প্রচলিত কল্পকথা ভেঙে দিয়েছেন। অনেকেই ভাবেন “আমি তো খুব ব্যস্ত”, “সব কাজেই জরুরি”—এসব ধারণার আসলে কতটা সত্যতা রয়েছে, তা বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। এরপর আসে লক্ষ্য নির্ধারণের বিজ্ঞান। SMART Goal মডেল, আই জেনহাওয়ার ম্যাট্রিক্স, এবং জীবন পরিকল্পনার বাস্তবধর্মী কৌশলগুলো পাঠককে সময়ের অগ্রাধিকার নির্ধারণে সাহায্য করে।
সময় অডিট – সময়ের আয়নায় নিজেকে দেখা:
আপনার সময় কোথায় যায় কেউ ভাবছেন কখনো? আমরা অনেকেই জানি না। সময় অডিট মানে হলো – নিজের সময় ব্যবহারের একটি আয়না ধরানো। আপনি কতটা সময় কাজে, বিশ্রামে, না-জরুরি কাজে দিচ্ছেন তা বুঝলেই দেখা যাবে আসল চিত্র। এই চর্চা আপনাকে অপ্রয়োজনীয় ব্যস্ততা থেকে মুক্ত করে, আসল অগ্রাধিকারে মনোযোগী হতে শেখায়। সফল সময় ব্যবস্থাপনার প্রথম ধাপই হলো — নিজেকে সময়ের আয়নায় দেখা। এই অধ্যায়টি বইয়ের অন্যতম শক্তিশালী অংশ। লেখক বলছেন, “সময় অডিট না করলে আপনি জানবেন না আপনার সময় কোথায় যাচ্ছে।” কাজের ধরন, সময়ের নিদর্শন বিশ্লেষণ, এবং কৌশলগত পরিবর্তনের মাধ্যমেই গড়ে উঠতে পারে কার্যকর পরিকল্পনা। এই অধ্যায় পাঠককে নিজের জীবনের টাইমলাইন বুঝতে শেখায়।
মনোযোগ, অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা:
সফলতা শুধু কারো একক প্রচেষ্টায় আসে না। প্রয়োজন গভীর মনোযোগ, অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ অনুপ্রেরণা এবং সময়মতো সহযোগিতা। মনোযোগ কাজের গতি বাড়ায়, অনুপ্রেরণা লক্ষ্য স্পষ্ট করে, আর সহযোগিতা সেই লক্ষ্য ছুঁতে পথ সহজ করে তোলে। যারা প্রতিনিয়ত এই তিনটি গুণ চর্চা করেন, তারা একা নয়—একসঙ্গে এগিয়ে যান। তাই এগিয়ে যেতে চাইলে, মনোযোগ দিন, অনুপ্রাণিত থাকুন, এবং পাশে থাকুন। আজকের তথ্য-অতিভারে ভারাক্রান্ত যুগে ফোকাস ধরে রাখাই একটি সুপারপাওয়ার। লেখক ১১টি কার্যকর কৌশলের মাধ্যমে দেখিয়েছেন কীভাবে মনোযোগ ও একাগ্রতা বাড়ানো যায়। এছাড়া সময় ব্যবস্থাপনায় আজীবন শেখার মানসিকতা, অনুপ্রেরণার উৎস, এবং ফিডব্যাক গ্রহণের কৌশল—সবকিছু এক জায়গায় গুছিয়ে উপস্থাপন করেছেন।
বাস্তব কেস স্টাডি ও প্রেরণার বিস্তার:
তত্ত্ব নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতাই সবচেয়ে বড় শিক্ষক। বাস্তব কেস স্টাডি আমাদের শেখায় কীভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মানুষ সফলতা অর্জন করে। এসব গল্প শুধু জ্ঞান নয়, জাগায় বিশ্বাস ও অনুপ্রেরণা। একেকটি কেস স্টাডি হলো চলমান জীবনের দর্পণ, যা দেখে আমরা নিজেদের সম্ভাবনার সীমা ছড়িয়ে দিতে পারি। প্রেরণার এই বিস্তারই পরিবর্তনের মূল চাবিকাঠি। শেষ অধ্যায়ে লেখক RMG সেক্টরের স্যাম্পল সেকশনকে সময় ব্যবস্থাপনার কেস স্টাডি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এতে দেখা যায় কীভাবে কার্যকর পরিকল্পনা, SOP, টিম সমন্বয় এবং প্রযুক্তির ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করা সম্ভব। সঙ্গে আছে ১২টি প্রেরণাদায়ক কৌশল—যেগুলো যেকোনো পেশায় বা পরিস্থিতিতে একজনকে চলার শক্তি জোগাতে পারে।
উপসংহার:
সময় ব্যবস্থাপনা কোনো যান্ত্রিক নিয়ম নয়; এটি একধরনের সচেতন জীবনদর্শন। আবদুল আজিজের “টাইম ম্যানেজমেন্ট” বইটি আমাদের দেখিয়েছে, কিভাবে সময় নয়, বরং অগ্রাধিকার নির্ধারণই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। বইটির প্রতিটি অধ্যায় বাস্তব জীবনের উপযোগী, সহজ ভাষায় লেখা এবং বাস্তব উদাহরণে ভরপুর, যা পাঠককে ভাবায়, বুঝায় এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে অনুপ্রাণিত করে। সময় অডিট, মনোযোগ বৃদ্ধির কৌশল, বাস্তব কেস স্টাডি, এবং SMART লক্ষ্য নির্ধারণ—এই উপাদানগুলো শুধু তথ্য নয়, একটি রোডম্যাপ হয়ে ওঠে। সময়কে যদি আপনি বন্ধু বানাতে চান, তবে এই বই আপনার জন্য। শেষ কথা হলো—জীবন ছোট, সময় দ্রুত চলে যায়। কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত, পরিষ্কার লক্ষ্য এবং সচেতনতা যদি থাকে, তাহলে এই সময় দিয়েই আপনি গড়ে তুলতে পারেন আপনার কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ। এখন সিদ্ধান্ত আপনার—আপনি সময়ের পেছনে ছুটবেন, নাকি সময়কে আপনার সঙ্গে হাঁটাবেন?
লেখক: আবদুল আজিজ
কন্টেন্ট রাইটার
Thank you