তৈরি পোশাক শিল্পে KPI ইমপ্লিমেন্টেশন করার সহজ কৌশল।
তৈরি পোশাক শিল্পে KPI (Key Performance Indicator) ইমপ্লিমেন্টেশন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । যা কারখানার উৎপাদন শীলতার বৃদ্ধির অন্যতম কৌশল। আমাদের দেশে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি গুলো উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে এখনো এশীয় সাত প্রতিযোগী দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। APO এর সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টা উৎপাদনশীলতার মূল্য ৩ দশমিক ৪ ডলার। চীনে ১১ দশমিক ১, শ্রীলঙ্কায় ১৫.৯ এবং ইন্দোনেশিয়ায় ১২.৩ ডলার। অথচ পোশাক রপ্তানীতে বিশ্বে আমরা দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছি। এই পর্বে আমরা জানবো KPI সম্পর্কে ? কেন KPI ইমপ্লিমেন্টেশন করতে হবে? আর KPI ইমপ্লিমেন্টেশন করার পদ্ধতিগুলো কি?কি?
কেপিআই (KPI) কী?
KPI (Key Performance Indicator) হলো একটা মানদন্ড। একজন ব্যাক্তি বা টিমের প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনের অগ্রগতি। সহজ কথায় কোন লোকের নিদ্দিষ্ট কাজের কর্মক্ষমতা। এটি ব্যবসার অগ্রগতির মূল সূচক মানে কেউ বা দলগত হয়ে কতটা কার্যকরীভাবে মূল ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যগুলো অর্জন করছে।
কীভাবে KPI কাজ করে?
KPI তৈরি পোশাক শিল্পের বিভিন্ন কার্যক্রম ও কার্যকারিতা পরিমাপ করে এবং উৎপাদন লক্ষ্য পূরণে সেই কার্যক্রমগুলো কীভাবে অবদান রাখছে তা বুঝতে সাহায্য করে।
যেমন:
- কারখানা: কোন কারখানার শ্রমিক সে কি কাজ করবে? কতটুকু করবে? তার কাজের লক্ষমাত্র কি এটা KPI দ্বারা পরিমাপ করা হয়।
- বিক্রয় বিভাগে: একজন সেলসম্যান সে মাসে কত বিক্রি করলো তার লক্ষ্য পূরণের হার।
- গ্রাহক সেবায়: গ্রাহকের সন্তুষ্টি সূচক।
- মানবসম্পদ বিভাগে: কর্মচারীর টার্নওভার হার।
তৈরি পোশাক শিল্পে KPI এর প্রয়োনীয়তা :
পোশাক রপ্তানীতে আমরা দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও উৎপাদনশীলতা কোন দেশের ধারেকাছেও নেই। শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে এখনো এশীয় সাত প্রতিযোগী দেশের তুলনায় আমরা সবার চেয়ে পিছিয়ে। এশিয়ান প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশনের (এপিও) সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টা উৎপাদনশীলতার মূল্য ৩ দশমিক ৪ ডলার। চীনে ১১ দশমিক ১, শ্রীলঙ্কায় ১৫.৯ এবং ইন্দোনেশিয়ায় ১২.৩ ডলার। তাহলে ভাবুন আমরা কত পিছিয়ে আছি। এর কারণ হলো আমাদের সঠিক KPI নাই, আমরা জানি না, আমাকে কি করতে হবে? কত সময়ের মধ্যে করতে হবে? কিভাবে গুনগত মান সম্পূর্ন পোশাক তৈরি করতে হবে। কিভাবে আমরা নিয়মিত পর্যবেক্ষন করে উৎপাদনশীলতাকে এগিয়ে নিতে পারবো।
তৈরি পোশাক শিল্প কারখানায় কিভাবে KPI সেট করবেন:
সময় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত KPI :
- প্রতি প্রোডাকশন লাইনে গড় কাজের সময় কত? এবং তার চেয়ে ১০% কমানো।
- সময়ের অপচয় চিহ্নিত করতে মেশিন লার্নিং মডেল ব্যবহার।
- ৯০% কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা।
- উৎপাদন শুরুর আগে প্রতিটি প্রক্রিয়ার সময় নির্ধারণ।
- প্রতিটি প্রক্রিয়ায় সময় কমানোর নতুন টেকনিক ব্যবহার।
দক্ষতা উন্নয়নের জন্য কর্মী প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত KPI
আমাদের শ্রমিক রা জানে না দক্ষতা কি? কেন দক্ষতা অর্জন জরুরী । আপনি যদি কারখানা গুলো পরিদর্শন করেন এবং কোন শ্রমিককে তার কি কাজ জানতে চান দেখন ৯০% লোক সঠিক জবাব দিতে পারবে না। এমনকি তাকে কি করতে হবে? কেন করতে? কতটুকু মান সম্পূর্ণ করতে হবে? কত সময়ের মধ্যে করতে হবে তাও বলতে পারবে না। একজন লোক যদি তার কাজের পারফরমেন্স নিয়ে পর্যালোচনা না করেন তাহলে তার দক্ষতা কি ভাবে অর্জন হবে। আমরা জানি দক্ষতা হলো সময়, শক্তি বা উভয়ই ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্ধারিত ফলাফলসহ কাজ সম্পাদন করার সক্ষমতা। তাহলে এখানেই তার KPI সেট হয়ে যায় কাজের সময়, সামর্থ, এবং জ্ঞান। আর এ বিষয়গুলো প্রত্যেকটি শ্রমিক কে নিয়োগের সময় ডুকুম্যান্টরি তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে সে কি করবে? কত সময়ে করতে হবে? কাজের ফলাফলের গুনগত মান কি হবে। এ বিষয়ে তাকে প্রশিক্ষন দিয়ে তারপর কাজ দিতে এবং ত নিদ্দিষ্টি সময়ে পর্যালোচনা করতে হবে।
KPI
- উদ্ভাবনী পদক্ষেপ:
- প্রযুক্তি ভিত্তিক প্রশিক্ষণ:
- মাল্টি-স্কিল ডেভেলপমেন্ট:
উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারের KPI
- ডিজিটাল ফ্যাব্রিক কাটিং এবং সেলাই প্রযুক্তি:
- অটোমেটেড কাটিং এবং সেলাই মেশিন চালু করা।
- রিয়েল-টাইম ডেটার ভিত্তিতে প্রতিদিন কাজের পরিকল্পনা তৈরি।
- ERP (Enterprise Resource Planning) সিস্টেম চালু করা।
ত্রুটি এবং অপচয় হ্রাসের জন্য KPI
- ত্রুটিমুক্ত উৎপাদনের হার (Zero Defect Production): (ত্রুটির হার ৫%-এর নিচে নিয়ে আসা।)
- প্রতিটি ধাপে মান নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম চালু।
- উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উপকরণের অপচয় ১০% কমানো।
- উপকরণ ব্যবহারের বিশ্লেষণমূলক রিপোর্ট তৈরিতে AI ব্যবহার।
কর্মী সন্তুষ্টি এবং অনুপ্রেরণা বৃদ্ধির জন্য KPI
- কর্মীর উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি: প্রতি কর্মীর উৎপাদনশীলতা ১৫% বাড়ানো।
- সাপ্তাহিক কর্মক্ষমতার ভিত্তিতে পুরস্কার ঘোষণা।
- কর্মীদের উপস্থিতির হার ৯৮% নিশ্চিত করা।
- বায়োমেট্রিক সিস্টেম ব্যবহার।
- কর্মীদের জন্য ফ্লেক্সিবল শিফট ব্যবস্থা চালু।
প্রক্রিয়া স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন সংক্রান্ত KPI
- ৬০% ম্যানুয়াল কাজ অটোমেটেড করা।
- প্রোডাকশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (PMS) চালু করা।
- ১০০% SOP মেনে কাজ করা।
- SOP শেখাতে ভিডিও টিউটোরিয়াল তৈরি।
গ্রাহকের সন্তুষ্টি সংক্রান্ত KPI
- অন-টাইম ডেলিভারি: গ্রাহক ডেলিভারির সময়ানুবর্তিতার হার ৯৫% নিশ্চিত করা।
- প্রোডাকশন শিডিউল ট্র্যাক করতে AI-ভিত্তিক প্ল্যানিং টুল ব্যবহার।
- গ্রাহক অভিযোগের হার ৩% এর কম রাখা।
- গ্রাহকের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য রিয়েল-টাইম ফিডব্যাক সিস্টেম প্রয়োগ।
ব্যাক্তিগত সংক্রান্ত KPI
- কি কাজ করতে হবে?
- কত সময়ের মধ্যে করতে হবে?
- কৃতকাজের রিজেকশন হার 2% এর কম রাখতে হবে।
- মাসিক পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করতে হবে
তৈরি পোশাক শিল্পের স্যাম্পল সেকশনে কিভাবে KPI সেট করবেন:
সঠিকভাবে তৈরি পোশাক শিল্পে KPI সেট করার জন্য নিম্নোক্ত ধাপগুলো অনুসরণ করা হয়:
যার জন্য KPI সেট করবেন, প্রথমে তার জন্য ক্লিয়ার গোল নির্ধারণ করুন, মানে সে কি পরিমান করবে, কখন করতে হবে? গুনগত মান কি হবে ।
যেমন একজন স্যাম্পল ম্যান তার KPI কি হওয়া উচিৎ, অনেকেই অনেকগুলো বিষয় আনেন KPI সেট করার ক্ষেত্রে এবং তাতে SOP সহ মিলিয়ে পেলেন মানে কোন KPI আর কোনটা SOP তা না বুঝেই । KPI (Key Performance Indicator) এবং SOP (Standard Operating Procedure) এক নয়; এগুলো ভিন্ন ভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। এগুলোর উদ্দেশ্য ও প্রয়োগের ক্ষেত্র আলাদা।
তৈরি পোশাক শিল্পে স্যাম্পল অপারেটর KPI :
- প্রতিদিন 3 পিছ করে স্যাম্পল তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আপনি নির্দ্দিষ্ট আইটেম অনুযায়ী পরিমাণ উল্লেখ করতে পারেন।
- স্যাম্পল অবশ্যই গুনগত মানসম্পূর্ণ হতে হবে।
- Internal rejection rate 2% এর অধিক হতে পারবে না।
- External rejection rate এক্সটারনাল রিজেক্ট 3% এর অধিক হওয়া যাবে না
তৈরি পোশাক শিল্পে স্যাম্পল লাইন চীফ এর KPI :
- Sample operator অনুযায়ী স্যাম্পল বরাদ্দ করবেন।
- Sample operator দের প্রয়োজনীয় টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিবেন।
- Sample operator দের daily sample production, সময়ের ডেটা সংরক্ষন করবেন।
- Daily sewing status প্রতিদিনকার উৎপাদন হিসেব পি. এম বরাবর উপস্থাপন করবেন।
তৈরি পোশাক শিল্পে স্যাম্পল পি এম KPI :
- ক্রেতার চাহিদাক্রমে স্যাম্পল প্ল্যান করা।
- স্যাম্পল তৈরিতে টিমের উৎপাদনশীলতা এবং কার্যকারিতা পর্যবেক্ষন করা।
- স্যাম্পল লাইনচীফ এবং অপারেটরদের টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিবেন
- টিম সদস্যদের (মাসিক) কার্যক্রম দক্ষতা হার নির্ধারন করবেন।
- স্যাম্পল অনুমোদন ( Internal & External) হার 96% উপরে রাখবেন।
- Daily স্যাম্পল সুইং হিসাব স্যাম্পল হেডকে অবহিত করবেন।
- Monthly অপারেটর দক্ষতা এবং Rejection rate স্যাম্পল হেড কে অবহিত করবেন।
তৈরি পোশাক শিল্পে KPI এবং SOP কি এক?
KPI (Key Performance Indicator) এবং SOP (Standard Operating Procedure) এক নয়; একেক টির সংজ্ঞা হলো একেক রকম যা ভিন্ন ভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। এগুলোর উদ্দেশ্য ও প্রয়োগের ক্ষেত্র আলাদা। নিচে এদের সংজ্ঞা এবং পার্থক্য তুলে ধরছি।
KPI (Key Performance Indicator): আমরা জানি KPI হলো একটি পরিমাপযোগ্য মান, মানে কোন ব্যক্তি, টিম কি করবেন? কত সময়ে করবেন তারা কর্মক্ষমতা এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি অগ্রগতি মূল্যায়ন নির্ধারণ। এর উদ্দেশ্য হলো প্রতিষ্ঠানের সফলতা এবং কর্মক্ষমতার পর্যালোচনা করা। যা লক্ষ্য নির্ধারণ, কর্মক্ষমতা পর্যবেক্ষণ এবং উন্নয়নের সুযোগ খুঁজে বের করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণ: একজন স্যাম্পল অপারেটর প্রতিদিন 3 পিছ স্যাম্পল সুইং করেন কিংবা একজন স্যাম্পল পি, এম মাসে তার সেকশনে 1000 পিছ স্যাম্পল উৎপাদন করবেন। যার অনুমোদন এর হার ৯৬%-এ উন্নীত করা।
SOP (Standard Operating Procedure):
SOP (Standard Operating Procedure): হলো একটি নির্দিষ্ট কার্যপ্রণালী বা ধাপে ধাপে নির্দেশিকা। কোনও নির্দিষ্ট কাজ বা প্রক্রিয়া সম্পাদনের জন্য ব্যবহৃত কার্য প্রণালীর ধাপ। উদ্দেশ্য হলো কার্যপ্রক্রিয়া গুলোতে ধারাবাহিকতা ও মান নিশ্চিত করা। যা একটি নির্দিষ্ট কাজ কীভাবে সম্পন্ন করতে হবে তা বিস্তারিতভাবে নির্ধারণ করা।
উদাহরণ: কাস্টমার জানতে চান যে তার অর্ডারকৃত কাজ কিভাবে করা হয়? সে কাজে গুনগত মান সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা কীভাবে গ্রহণ করা হয়? সমাধান করতে কি করেন তার নির্দেশিকা?
পরিশেষে:
উৎপাদনমূখী শিল্পের মূল ভিত্তি হচ্ছে উৎপাদনশীলতা। মানে একটা কারখানার সম্পদ ব্যবহারের অনুপাত। উপকরণ ব্যবহারের দক্ষতা বা কার্যকারিতাকে উৎপাদনশীলতা বলা হয়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প বর্তমান বিশ্ববাজারে নিজকে টিকিয়ে রাখতে হলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ছাড়া অন্যকোন উপায় নাই। কিন্তু আমাদের দেশের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা এশীয় সাত প্রতিযোগী দেশের তুলনায় সবার চেয়ে পিছিয়ে আছে। APO (এশিয়ান প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশনের)সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টা উৎপাদনশীলতার মূল্য ৩ দশমিক ৪ ডলার। চীনে ১১ দশমিক ১, শ্রীলঙ্কায় ১৫.৯ এবং ইন্দোনেশিয়ায় ১২.৩ ডলার। ২০১৯ সালে বিদ্যমান কারখানাগুলোতে ১ হাজার টাকা সমমূল্যের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রায় ৪ হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছিল। যদিও সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে প্রতি ঘণ্টায় গড় উৎপাদনশীলতা ৫ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও সেই লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বাস্তবে কতটুকু সম্ভব আর কি ভাবে তা আমাদের ই নির্ধারণ করতে হবে।
আবদুল আজিজ
হেড অব স্যাম্পল এন্ড ইনোভেশন
স্ট্যার্ন্ডাড গ্রুপ (MH)