বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বর্তমান অস্থিরতা কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? এ প্রশ্নটি এখন সকলের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এই অস্থিরতা দেশের অর্থনীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধরনের অশনি সংকেত। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। দেশে মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪% সরবরাহ করে এই খাত। দেশের প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের জীবিকার অন্যতম মাধ্যম হলো তৈরি পোশাক শিল্প । কিন্তু অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটি চরম সংকটাপন্ন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে যা এই শিল্পের জন্য বড় রকমের অশনি সংকেত। তাই কোনো কিছু করার আগে ভাবুন! কি করতে যাচ্ছেন? কার উসকানিতে পা দিচ্ছেন? উসকানি দাতার পেছনে যাবার আগে শতবার ভাবুন। নচেৎ নিজের হাতেই ধ্বংস করে দিবেন অর্থনীতির স্বচ্ছলতার প্রতীক এই খাতটি। কিন্তু কেন এই অস্থিরতা? তা নিয়ে আলাপ করবো আজকের ব্লগে।
পোশাক শিল্পের অস্থিরতার বড় কারণ রপ্তানি আদেশ কমে যাওয়া।
বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পোশাক খাতে বাংলাদেশের ১০% রপ্তানি আদেশ কমেছে। কোভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ধীরগতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে। ফলে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় বাজারে পোশাকের চাহিদা কমেছে। তার উপর ডলার সংকট, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি, এবং বিদ্যুৎ-গ্যাসের ঘাটতির কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়া। পাশাপাশি ভিয়েতনাম, ভারত ও ইথিওপিয়ার মতো দেশগুলো সাশ্রয়ী মূল্যে গুণগত মানের পোশাক সরবরাহ করায় ক্রেতারা সেসব দেশে ঝুঁকছে।
রপ্তানি আদেশ বাড়ানোর জন্য নতুন বাজার অন্বেষণ করতে হবে।
আমি মনে করি নতুন বাজার অনুসন্ধান, উৎপাদন ব্যয় কমানো এবং বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদনের দিকে ঝুঁকতে হবে। আমাদের গার্মেন্টস ফ্যা:গুলো সাধারণত এক অর্ডার বারবার প্রত্যাশা করে, কিন্তু বিশ্ববাজার সবসময় নতুনের দিকে ঝুঁকছে। মানুষ এখন উচ্চমূল্যের পোশাক এবং পরিবেশবান্ধব পোশাক উৎপাদনে মনোযোগ দিচ্ছে। যার জন্য ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এশিয়া, লাতিন আমেরিকা, এবং আফ্রিকার নতুন বাজারে প্রবেশের কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সুনাম বৃদ্ধি করতে ব্র্যান্ডিং প্রচারণা জোরদার করা দরকার।
পোশাক শিল্পে উৎপাদন ব্যয় কমাতে হবে।
ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে উৎপাদন ব্যয় কমাতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কাঁচামালের জন্য বিকল্প উৎস খুঁজে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করতে হবে। পাশাপাশি আধুনিক মেশিনারি ও প্রযুক্তি সংযোজন করে উৎপাদন প্রক্রিয়া আরও দক্ষ এবং সময় সাশ্রয়ী করতে হবে। মানসম্পন্ন উৎপাদন সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষিত কর্মী ব্যবহার করে রিজেকশনের হার কমাতে হবে। এছাড়াও আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশে কাঁচামাল উৎপাদন বাড়াতে হবে যার ফলে পরিবহণ খরচ ও শুল্ক ব্যয় কমবে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অপচয় কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি (যেমন সোলার প্যানেল) ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানি ব্যয় হ্রাস করতে হবে।
পোশাক শিল্পে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে:
উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধির মাধ্যমে পোশাক শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে। অটোমেশন এবং ডিজিটালাইজেশন করে আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তির পাশাপাশি ডিজিটাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমগুলো গ্রহণ করতে হবে। শারীরিক পরিশ্রমের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বয়ংক্রিয় মেশিন এবং সফটওয়্যারের ব্যবহার বাড়িয়ে উৎপাদন প্রক্রিয়া দ্রুত এবং কার্যকর করতে হবে। উৎপাদনের প্রতিটি ধাপের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করে সময় এবং সম্পদ সাশ্রয় করতে হবে। দক্ষ ব্যবস্থাপকের নেতৃত্বে প্রতিটি ইউনিটের কাজ তদারকি ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
পোশাক শিল্পে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে শ্রমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, আমরা উৎপাদনশীলতায় অন্যদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছি । পোশাক শিল্পে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়িয়ে উৎপাদনের গুণগত মান উন্নত করতে এবং সময় সাশ্রয় করতে সহায়তা করবে। কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের মধ্যে উৎপাদনশীলতা সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও আলোচনা সভা আয়োজন করতে হবে। আধুনিক মেশিনের ব্যবহার, কাটিং, সেলাই, এবং ফিনিশিং-এর মতো বিশেষায়িত কাজের জন্য শ্রমিকদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দিতে হবে। উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে গুণগত মান বজায় রাখার জন্য মান নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। কার্যকর যোগাযোগ এবং সমন্বয়ের মাধ্যমে উৎপাদন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে দলগত কাজের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কার কি দায়িত্ব সেটা ডুকুম্যান্টরি ভাবে দিতে হবে । প্রশিক্ষণ কর্মসূচির পাশাপাশি পুরস্কার ও স্বীকৃতির ব্যবস্থা শ্রমিকদের আরও কর্মঠ করে তুলবে । এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলো শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়িয়ে উৎপাদনশীলতা এবং গুণগত মান বৃদ্ধি করবে, যা শিল্পের টেকসই উন্নয়নে সহায়ক।
পোশাক শিল্পের অস্থিরতার অন্য কারণ হলো শ্রমিক অসন্তোষ।
দেশব্যাপী ছাত্র জনতার আন্দোলন পাশাপাশি শ্রমিক অসন্তোষ পোশাক শিল্পে মরার উপর খাঁড়ার ঘা এর মত। আগস্টের শেষে শুরু হওয়া এ নৈরাজ্যের সঠিক কোন কারণও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না যদিও দাবি মানার পরও আন্দোলন-ভাঙচুর হচ্ছেই। কিন্তু তাদের দাবিগুলো সুনির্দিষ্ট নয়, একেক কারখানায় একেক ধরনের । যদিও অনেকেই শুরুতে উসকানি ও ষড়যন্ত্রের কথা ভাবছিলেন কিন্তু তারও কোন সমীকরণ মিলছে না ফলে দানা বাঁধছে নানা সন্দেহ। পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো গুজব। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মধ্যে মজুরি, ছাঁটাই বা কারখানা বন্ধের মতো বিষয়ে সঠিক তথ্যের অভাব থাকে। এই ফাঁকটি কাজে লাগিয়ে অসৎ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী গুজব ছড়িয়ে শ্রমিকদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করে। এছাড়া অনেক শ্রমিক তাদের অধিকার বা কোম্পানির সিদ্ধান্ত সম্পর্কে যথাযথ তথ্য জানেন না। ফলে গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আরেক টি বিষয় হলো শ্রমিক ও মালিকপক্ষের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব থাকায় গুজব সহজেই প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অস্থিরতার ফলে অর্থনীতির উপর প্রভাব।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক খাত । দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পোশাক শিল্পের কোনো বিকল্প নাই। আমাদের অর্থনীতিতে তিনটি রপ্তানিমুখী খাতের মধ্যে পোশাক শিল্পই অন্যতম। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪% সরবরাহ করে। অস্থিরতার ফলে রপ্তানি কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সংকট দেখা দেয়, যা অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় বিঘ্ন ঘটায়। তাছাড়া শ্রমিক ছাঁটাই ও কারখানা বন্ধ হয়ে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে । ফলে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে , যা অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা হ্রাস করবে। অস্থির পরিবেশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দিবে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করবে। চাকরি হারানো শ্রমিকদের কারণে শহরাঞ্চলে অপরাধ এবং সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যেতে পারে। পোশাক শিল্পের স্থিতিশীলতা অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই অস্থিরতা দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
পোশাক শিল্পের অস্থিরতায় সামাজিক স্থিতিশীলতার উপর প্রভাব।
তৈরি পোশাক শিল্প এদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করছে যাদের সিংহভাগই নারী। সমাজের পিছিয়ে পড়া এই জনসমষ্টি অনেকাংশেই স্বাবলম্বী যার ফলে সমাজে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন হয়েছে। কিন্তু পোশাক শিল্পের এই অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে সমাজে অস্থিরতা বৃদ্ধি করবে। যার সম্ভাব্য প্রভাব পড়বে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি। বেকার শ্রমিকরা জীবিকার বিকল্প উৎস না পেলে শহরাঞ্চলে চুরি, ডাকাতি, মাদকদ্রব্যের ব্যবসার মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাড়তে পারে। এছাড়াও সৃষ্টি হতে পারে পরিবারভিত্তিক সংকট। কারণ পোশাক শ্রমিকরা সাধারণত নিম্ন আয়ের শ্রেণির মানুষ। কাজ হারানো বা আয় কমে যাওয়ার ফলে তাদের পরিবারে শিক্ষার অভাব, অপুষ্টি এবং অন্যান্য সামাজিক সমস্যা বাড়বে। সবচেয়ে বড় প্রভাব সৃষ্টি করবে সামাজিক বৈষম্যে, চাকরি হারানো শ্রমিকদের জীবনে দুরবস্থা সমাজে আরও বৈষম্যের সৃষ্টি করবে। জাতির বৃহৎ স্বার্থে অস্থিতিশীলতা নিরসন করে স্থায়ীভাবে নিশ্চিত করতে হবে স্থিতিশীলতা।
উপসংহার:
আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলে তৈরি পোশাক শিল্প যার মাধ্যমে লক্ষাধিক মানুষের জীবিকার সংস্থান হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান অস্থিরতা শিল্পের স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। টানা শ্রমিক অসন্তোষ একদিকে যেমন ছোট বড় অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হচ্ছে অন্যদিকে সহিংসতায় ধ্বংস হচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এই অস্থিরতার কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করেন দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার । যারফলে তৈরি হওয়া সামাজিক অস্থিরতার জন্য চাঞ্চল্যকর হত্যার ঘটনা ঘটছে অহরহ। এই অস্থিরতার ফলে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রাজস্ব হারিয়েছে। তবে অনেকেই মনে করেন শুরুতে পোশাক কারখানার জুট ব্যবসা নিয়ে বহিরাগতরা পোশাক কারখানায় নানা অস্থিরতায় ইন্ধন দিলেও বর্তমানে গুজব ছড়িয়েও শ্রমিকদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছে। আরেক বিষয় শ্রমিক হাতিয়ার করে নিয়েছে মব জাস্টিস যেটা হলো তাদের অপছন্দের কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দিতে হবে কোন কোন ক্ষেত্রে তারা আইন ও হাতে তুলে নিচ্ছে। তবে এই অস্থিরতা বন্ধ হউক, একটি নিরাপদ, কর্মক্ষম এবং সুষ্ঠু পরিবেশই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
আবদুল আজিজ
হেড অব স্যাম্পল এন্ড ইনোভেশন
স্ট্যার্ন্ডাড গ্রুপ (MH)